২০০৭সাল.... সার্জারী ওয়ার্ড! এক ছেলেকে তার নববধূ নিয়ে এসেছে ৷ যার প্রচন্ড পেট ব্যথা, সেই সাথে পেট ফুলে যাচ্ছে। ইন্টেস্টিনাল অবস্ট্রাকশান...
২০০৭সাল.... সার্জারী ওয়ার্ড!
এক ছেলেকে তার নববধূ নিয়ে এসেছে ৷ যার প্রচন্ড পেট ব্যথা, সেই সাথে পেট
ফুলে যাচ্ছে। ইন্টেস্টিনাল অবস্ট্রাকশান সাসপেক্ট করা হল ৷ প্রফেসর
সিদ্ধান্ত নিলেন ইমার্জেন্সী ল্যাপারোটমী করবেন। করা হলো ৷ পেট খুলে সবাই অবাক!! সিগময়েড কোলনে অনেক বড় গ্রোথ! এইদিকে মেটাসটেসিস এর জন্য কিচ্ছু করার উপায় নেই ৷ তাই অগত্যা শুধু কোলোস্টমী করা হল। একদিকে রক্তের দাগ, অন্য দিকে মেহেদী রাংগানো হাত, মাঝখানে মৃত্যু...!!
ছেলেটার এর আগে কোনদিন এমন হয়নি! কোন সাইন সিম্পটম ছিলনা! একজন ইন্টার্ন ছেলেটাকে তখন রেগুলার ফলো আপ করতো ৷ ওকে দেখতে আসলেই ইন্টার্ন ডাক্তার এর মন খারাপ হয়ে যেত ৷ তাই মাঝে মাঝেই ওর সাথে কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলত হাসা হাসি করতো এবং সাহস দিত। ওই ছেলের সাথে তার লাজুক অথচ শংকিত স্ত্রীও সেই আড্ডায় যোগ দিত।
তার জন্য তার স্ত্রীর কষ্টের শেষ নেই, প্রায় মৃত স্বামীর জন্য তার সেবা যত্ন দেখলে সত্যি মায়া হয়। ডাক্তার এর উদ্দেশ্য একটাই, ওদের সম্পর্কে আরো কিছু জানা আর একটু সান্ত্বনা দেয়া। মেয়েটা প্রাইমারী স্কুলে চাকুরী করত, আর ছেলেটা ছিল মালদ্বীপ প্রবাসী। ওখানে সে টুনা মাছের একটা কোম্পানীতে কাজ করতো। বিয়ের ১ মাস পরেই স্ত্রীকে নিয়ে মালদ্বীপ যাবার ইচ্ছে ছিল ছেলেটার । যেদিন ছেলেটার অপারেশান হয় সেদিন ছিল ওদের বিয়ের তেইশ তম দিন!!
যেদিন ওদের বিয়ের ১ মাস পূর্ণ হল সেদিন, ইন্টার্ন ডাক্তার, ওই ছেলের বউ, আর ওই ছেলে, বিকেল বেলা কথা বলছিলেন। ছেলেটা তখন একটু আধটু বসতে পারে। কিভাবে যেন ছেলেটা জেনে যায় তার ক্যান্সার আক্রান্ত হবার কথা আর ক্যামোথেরাপীর প্ল্যানিং এর কথা। তার হিষ্টোপ্যাথলজী রিপোর্ট এর পেন্ডিং থাকাটা ছিল শুধুই একটা সম্ভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখা...!
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে।সেদিন সন্ধ্যায় ছেলেটা একটুও না ভয় পেয়ে মেয়েটাকে বলে " আমার স্মৃতি নিয়ে বসে থেকোনা, চাইলেই তুমি আমার মৃত্যুর পর অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারো, ওপারে গিয়েও আমি সুখ পাবো, ভাববো, আমি যা দিতে পারিনি তা তুমি ঠিকই বেছে নিলে"।
সেদিন একটু গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। ছেলেটার সেদিন খুব শ্বাস কষ্ট হচ্ছিল।তার প্রেসার কমে গেল, শরীর ঘামছিল। এর দুইদিন আগে তার জ্বর হয়েছিল, এখন শরীর প্রচন্ড ঠান্ডা। হাসপাতালে ভর্তির ২১ দিন পর তাকে প্রথম কেমো দেয়া হয়। কেমোর ধকল, শারীরিক দুর্বলতা, রক্তস্বল্পতা, ক্যান্সার এর দ্রুত ছড়িয়ে পড়া সব মিলিয়ে তার অবস্থা খারাপ হতে হতে আজ তা চুড়ান্ত। সকাল থেকেই তার উৎকন্ঠা কখন তার স্ত্রী আসবে, তাকে এক নজর দেখবে। নিজের এভাবে স্বার্থপরের মত চলে যাওয়াটা তার ভেতর প্রচন্ড অপরাধ বোধ এর জন্ম দেয়। ছেলেটার আত্মীয় বান্ধব বলতে তেমন কেউই ছিলনা শুধু তার মা আর অসুস্থ্য বাবা ছাড়া।
দুপুরের দিকে সেই ইন্টার্নী ডাক্তারের দৌড়াদৌড়ি বেড়ে গেল। ওর মাকে বলে ওর বৌকে আনার ব্যবস্থা করা হল। ছেলেটার বুকের উপরে রাখা হাতে মেহেদীর দাগ মুছে গিয়েছে এখন সেখানে ছোপ ছোপ কালো কালো দাগ আর স্যালাইনের নল। মাথায় চুল পুড়ে গিয়ে , ওজন কমে ছেলেটার চেহারা বদলে গেছে। আজ এই দুপুরে শুধু ওর বুক উঠানামাই জানান দিচ্ছে সে তখনো বেঁচে আছে।
একটু পরেই ছেলেটার বৌ ঝড়ের বেগে ওয়ার্ডে ঢুকল, ততক্ষনে সব শেষ! মেয়েটা ছেলেটার নিথর হাতটা ধরে বসে ছিল, অনেক্ষন তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল, সেদিন তার মুখে কোন কথা ছিলনা।ইন্টার্ন ডাক্তার এর চোখও সেদিন জ্বলে উঠেছিল।
এই ওয়ার্ডটা আগামী সপ্তাহেই শেষ হয়ে যাবে, ইন্টার্ন ডাক্তার এর মাথায় শুধুই বেড নাম্বার ১০ ঘুরতে থাকে, কত স্মৃতি....।
এইতো সেদিন তিন জনে হাসাহাসি করছিল। ছেলেটা ডাক্তারকে বলেছিল সুস্থ্য হয়ে উঠলে মালদ্বীপ ওরা যাবার পর ডাক্তারকে দাওয়াত দেবে। বিদায় বেলায় তরুন ডাক্তার শুধু বেড ১০ এর কথাই ভেবেছিল আর ভেবেছিল আজ থেকে ৫ বছর পর সদ্য বিধবা মেয়েটাকি ছেলেটার এপিটাফ ধরে কাঁদবে? নাকি অন্য কারো হাত ধরে নতুন সুখের ঘর বাঁধবে?
এই অমীমাংসিত প্রশ্নের জবাব হয়তো বিধাতাই জানেন!!
-------------------------
লেখা - ডাঃ মৃণাল সাহা
----------------------------------------------------------সবাইকে মেডিকেলীয় আড্ডা গ্রুপে যোগ দেয়ার আমন্ত্রন -
------ মেডিকেলীয় আড্ডা গ্রুপ
গ্রুপ ও পেইজে যোগ দিতে নীল লেখার উপর ক্লিক করুন ।
মেডিকেলীয় আড্ডা
মেডিকেল প্রতিদিন -বিনোদন সারদিন
এ সাইটে লিখতে যোগাযোগ করুন -
ডাঃ স্বাধীন -- link- http://fb.com/DrReal