সে এখন পথশিশু নয়, ডাক্তার

ভাইয়া, ফুল ন্যাবেন?' -পিঠে হাত দিয়ে ছোট্ট একটা মেয়ে আমাকে ফুল দেখাচ্ছিল। বনানী কবরস্থানে এরকম মেয়ে হরহামেশাই দেখা যায়।


ভাইয়া, ফুল ন্যাবেন?'
-পিঠে হাত দিয়ে ছোট্ট একটা মেয়ে আমাকে ফুল দেখাচ্ছিল। বনানী কবরস্থানে এরকম মেয়ে হরহামেশাই দেখা যায়।


আমি একা। মা মারা গেছেন আরো ছয় বছর আগে। বাবা এখন পর। অন্য মহিলাকে বিয়ে করে বেশ সুখেই আছে। আমাকে দেখাশোনা করার মত ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে একজনও নেই। বনানী কবরস্থানে আমি প্রায়ই বসে থাকি। মন খারাপ লাগলে, এ কবরস্থানে এসে বসে থাকি। এখানে যে আমার মা শুয়ে আছে।

ফুলওয়ালা এ মেয়েটার চোখে কেমন যেন দুঃখের ছাপ। তার পিঠে হাত দিয়ে আমি বসতে বললাম।
-কী নাম?
-জোছনা।
-বাহ!! বেশ নাম তো...
মেয়েটা পোকলা দাতে হেসে দিলো।
-তুমি ফুল বিক্রি ছাড়া আর কি কর?
-কিসু না।
-পড়াশোনা করোনা?
-জ্বে না, আমার বাপে পিটাইবো।
-ও, তোমার বাবা কি করে?
-আমার বাপে সারাদিন পচাপানি খায়। এর লাইগ্যা আমার থেকে ট্যাকা নেয়।
-তোমার মা কিছু বলেনা?
-আমার মায় মইরা গেসে। নতুন মায় কিসু কয় না।
-তোমার কি এখানে থাকতে ইচ্ছে করে?
-না।
-আমার সাথে যাবা?
-হ যামু।
-আজ থেকে তুমি আমার বোন।

মেয়েটা বুঝতে পারছিল না। তবে কেন জানি হাসছিল। ধানমণ্ডির এক কোণে আমার মেস। ঠিক মেস বলা যায় না। সাবলেটে একটা বাসা নিয়ে একাই থাকি। কিছু ছাত্র-ছাত্রী পড়াই আর মাঝে মাঝে গল্প কবিতা লিখি। এগুলো দিয়েই আমার পেট চলে। মেয়েটার হাতের ফুলগুলো আমার হাতে নিয়ে নিই।

বাসায় আনার আগে ওকে নিউমার্কেট নিয়ে যাই। রাস্তার ধার থেকে সত্তর টাকা দিয়ে দুটো ফ্রক কিনে দিই তাকে। তার মুখটা সূর্য হয়ে গেলো সাথে সাথেই।

জ্যোস্নাকে নিয়ে ঢাকা কলেজের সামনে দিয়ে আসছি। জ্যোস্না ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে।

-স্যার, আপনে আমারে কই নেন?
-কিরে? ভাইয়া থেকে স্যার?

মেয়েটা চুপ হয়ে গেলো। আমি তাকে বললাম, 'শোন, আমি তোর আপন ভাই। আজ থেকে আমাকে ভাইয়া ডাকবি আর তোর নাম জোছনা না। তোর নাম আবৃত্তি।'

ও নামের অর্থ বোঝেনি। কিন্তু খুশি হয়েছিল। তাকে নিয়ে উঠলাম আমার ছোট্ট সংসারে। নিজেকে কেমন যেন ভাগ্যবান লাগছিল। যাযাবর জীবনের অবসান হবে হয়তো।

আবৃত্তির বয়স বারো কি তেরো হবে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দিই তাকে। ওয়ান থেকে ফাইভের পড়াগুলো প্রতিদিন রাতে অল্প অল্প করে শিখিয়ে দিই। মেয়েটার স্মৃতিশক্তি ধারালো।

আমাদের ভাই বোনের সংসার বেশ কিছুদিনের মধ্যেই জমে উঠলো। আমরা এখন কেউই দুঃখী না। ও আমাকে দাদা বলে ডাকে।

একদিন ঘরে চাল নেই। মাসের শেষের দিকে। আমারও পকেটে কোনো টাকা পয়সা নেই। আবৃত্তি বুঝতে পারলো। চৌকির নিচ থেকে একটা মাটির ব্যাংক বের করে সে আমাকে টাকা দিলো।

এক বছর কেটে গেল। আবৃত্তির চেহারাই বদলে গেলো। সেই সাথে আমার জীবনও। আবৃত্তিকে নিয়ে আমি আস্ত একটা উপন্যাস লিখে ফেলি। এক মাসেই সেই উপন্যাস তিন বার মুদ্রণ হয়। এক পরিচালক এটা নিয়ে সিনেমা বানানোর কথাও বলেছেন। হয়তো-বা আমার জীবনটা বদলে যাবে।

হ্যাঁ, কিছুদিনের মধ্যেই আমার জীবন কিছুটা বদলে গেল। রাজধানীর নামকরা স্কুলে আমার বোনকে ভর্তি করাতে পারলাম। নিখুঁত মেধার জন্য আমার বোন সুনাম কুড়াচ্ছে। আবৃত্তিকে নিয়ে লিখা, 'বোনটি' উপন্যাসের কারণে তখন আমাকে অনেক মানুষ চিনে।

আবৃত্তি এখন ক্লাস নাইনে। আমার ঘোলাটে চোখে স্পষ্ট দেখলাম একটা ব্যাচ। 'ডা. আবৃত্তি'। হ্যাঁ এটা কল্পনা ছিল। আর সেই কল্পনাকে সত্য করার জন্য আমি আমার বোনকে সাইন্সে পড়াই।
-দাদা
-হুম বল
-তুই খুব ভাল
-তুই আরো ভালো।

নতুন বই হাতে নিয়ে আমার বোন আমাকে এসব কথা বলছিল। সে যখন খুব খুশি হয় তখন সে এমন করে। আবৃত্তি জানে তাকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। আমার পড়াশোনা শেষে ছোটখাটো একটা চাকরি করি। আর আমার বোন স্কুল করে, আমার জন্য রান্না করে। আমি বাসায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত সে খায় না। হয়তো-বা ওভাবেই খাওয়ার অপেক্ষায় ঘুমিয়ে পড়ে।

মাঝে মাঝে ভাবি, আমি হয়তো পৃথিবীর সুখী মানুষদেরই একজন। আবৃত্তির মতো একটা বোন পেয়েছি আমি। এ মেয়েটা না আসলে হয়তো আমার জীবন এলোমেলো হয়ে যেত। হয়তো-বা আমি ওভাভেই মেসের কোনে পড়ে থাকতাম।

তিন বছরের মতো হয়ে গেলো সে আমার কাছে। এখন তার মনে নেই সে এক সময় ফুল বিক্রি করতো। এখন তার মনে নেই সে এক সময় যাযাবর ছিল। আমারো এখন মনে হয় না আমি এ পৃথিবীতে একা।

একদিন সে বলছিল-
-দাদা, আমি একটা জিনিস চাইবো, দিবি?
-কি?
-একটা ভাবী।
-এখন না।
-দিবি কেন? আমি তো তোর পালক বোন।

আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এ মেয়ে এটা কেন বললো? কথাটা বলেই সে তার ঘরে চলে গেলো। আমি তার ঘরে গেলাম। তার চুলে হাত বুলিয়ে বললাম-
-কিরে?
-কিছু না।
-তুই এটা কেন চাইলি?
-দাদা, সবাই স্কুলে মায়ের সাথে যায়। তুই তো আমাকে মা দিতে পারবি না। একটা ভাবি দে।

তার কথায় হেসে উঠলাম আমি। মেয়েটার কথায় একটু দুঃখও আছে। সেটা উজ্জ হয়ে গেলো।

এস.এস.সি পাশ করে ফেলেছে আমার বোন। আমার সবচেয়ে খুশির দিন। আমার চেষ্টায় আজ একটা মেয়ে জীবন চিনতে শিখেছে।

তার হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কেদে দিই। আমার চোখের কোণের পানি আমার বোনটা নিজ হাতে মুছে দেয়। বড় হতে হতে আমার বোনটা অনেক বদলে গেছে। আবৃত্তির ভেতর এখন আর জোছনার ছাপ নেই, আছে চাদের আলোর ছাপ। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে সে।

আমার নিজের কষ্ট হলেও আমার বোনকে আমি অন্য দশটা মেয়ের মতো চলতে দিতাম। দামী জামা, জুতো, নেইল পালিশ কিনে দিতাম। সে শুধুই অবাক হয়ে থাকতো আমার এসব দেখে।

আমার আর্থিক অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। লিখালিখির খাতিরে চাকরির পাশাপাশি একটি পত্রিকায় সাংবাদিকতাও করি। তবে আমার বোনকে সময় দেয়া হতো কম। সেও আমার স্বপ্ন পূরণে ব্যাস্ত। আমি তাকে বলেছিলাম, 'আবৃত্তি নামের আগে ডাক্তার দেখা চাই।'

আবৃত্তি মিষ্টি হেসেছিল। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, 'দাদা, তুই দেখিস, তোর বোনটা একদিন ডাক্তার হবেই। '

পাঁচ বছর পর-
একটা চায়ের দোকানে বসে আছি। হুট করে পিছন থেকে কে যেন আমার পিঠে হাত দিলো।

'ভাইয়া, ফুল ন্যাবেন ফুল?'
-আমি তাকালাম। একটা মেয়ে আমাকে এভাবে বলছে। আজ থেকে চৌদ্দ বছর আগে আমাকে এটা বলেছিল আবৃত্তি। আমি কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। চায়ের দোকানে কেন ফুল বিক্রি করতে আসবে? আমি চারদিকে তাকালাম।

সাদা একটা গাড়ি থেকে নামলো আবৃত্তি। আমার পা ছুঁয়ে আমাকে সালাম করলো। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তার স্বামী। আমার বোন আজ মেডিকেল শেষ করে ফেলেছে। আমি আজ থেকে ডাক্তারের ভাই।

আবৃত্তি যখন থার্ড ইয়ারে, তখনই আমি তার বিয়ে দিই। এখন সে খুব সুখে আছে। আমার চোখের পানি আনমনেই মাটিতে পড়ে। আমার বোনটাও কেদে দেয় হুহু করে।

জিজ্ঞেস করলাম, ফুল ওয়ালা মেয়েটাকে কে পাঠিয়েছে? 'হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে সে বললো, 'এটা তার কাজ।'

আমি পেরেছি একটি পথশিশুকে ডাক্তার বানাতে। আমি সফল। আমার জীবনে কোন দুঃখ নেই। আমি আজ সুখী।

না, সে পথশিশু নয়। সে আমার বোন। ছোট বোন ডা. আবৃত্তি......

লেখক : Alaxender Abi
নাম

অবিশ্বাস্য ঘটনা,10,আপনি জানেন কি ?,8,আবিদুর রহমান নিশাত,3,এ্যাম্বুলেন্স,1,ওমর ফারুক মসিহ্,1,কম্পিউটার,6,কি কেন কিভাবে,14,খবর,4,খেলাধূলা,1,গল্প কবিতা,4,জরুরী রক্ত সরবরাহ,2,ডাঃ আব্দুল্লাহ সায়ীদ খান,1,ডাঃ জুয়েল,1,ডাঃ মৃণাল সাহা,1,ডাঃ রবিউল,1,ডাঃ শামীম রেজা,2,ডাঃ স্বাধীন,5,ডাক্তারদের কলাম,24,ডাক্তারদের চেম্বার,1,ডাক্তারদের লেখা,24,ডাক্তারের পরামর্শ,8,ডায়াগনস্টিক সেন্টার,1,নিউজ,2,প্রফ প্রসংগ,2,প্রফেসরদের বানী,2,প্রযুক্তি সমাধান,10,প্রাইভেট,2,বই,1,বাংলাদেশ,1,বিনোদন,35,বিশেষ বিজ্ঞপ্তি,16,বিসিএস,8,ব্যক্তিত্ব,2,ভর্তি পরীক্ষা,6,মনীষী,1,মুক্তমত,27,মুনাদি আল ইসলাম,1,মুহাম্মদ ইফাজ হাসবুল্লাহ,1,মেডিকেল কলেজ,7,মেডিকেল বই ডাউনলোড,12,মেডিকেলীয় সঙ্গীত,2,মেধাবী মুখ,3,মোঃ শরীফুল ইসলাম খান,1,রাফিদ আহমেদ,1,সম্পাদকীয়,36,সরকারী,1,সাখাওয়াত হোসাইন,12,সাজেশন,7,সাধারণ জ্ঞান,20,সুপ্ত প্রতিভা,1,স্বাস্থ্য বার্তা,53,হাসপাতাল তথ্যাদি,13,Abdullah Ashique,5,Abidur Rahman Nishat,7,Al Amin,2,Anatomy,5,Android,7,Asibur Rahman,1,Atiqur Rahman,1,BCS,10,BMDC,1,Bones,1,books,4,bre,1,Breaking News,55,Computer,11,Cricket,2,Doctors Advice,12,Doctors Articles,64,DownLoad,16,Dr Abdullah Sayeed Khan,1,Dr. Saleh Uddin Suman,1,Dr. Tanvir Ahmed,1,Dr.Abdullah Sayeed,3,Dr.Asad Zaman,1,Dr.Golam Sarwar,1,Dr.Jewel,2,Dr.Muhsin Abdullah,1,Dr.Rabiul Haque,1,Dr.Sakhawat,10,Dr.Sayeed Uddin,1,Dr.Shadin,1,Dr.Shamim Reza,1,DrSayed Sujon,4,Editor,30,FCPS,2,Funny Post,51,Games,1,General,6,hea,1,Health Tips,33,HealthNews,49,Hospital,2,ICON,1,Kolponar Rong,1,Lecture Video,1,Mahfuzur Rahman Himel,2,Mainul hasan Riyad,1,MBBS,8,Medical Books,4,Medical College,6,Medical Science,14,Medical Software,5,Mobile,7,Mubasshir Hasan Limon,2,Mujakkir Rahman Piash,1,Munadi Al Islam,1,Nishat,1,Operation,1,Pathology,1,PC help,5,Personality,2,Professor Dr.Nurul Islam,1,Result,1,Sakhawat Crsc,25,Science,1,Software,5,Sports,6,Surgery,2,Tanbir,1,Technology,9,TechTips,27,tre,1,Treatment,20,Walid Bin Amir,1,What Why How,3,
ltr
item
Medicallife24.com: সে এখন পথশিশু নয়, ডাক্তার
সে এখন পথশিশু নয়, ডাক্তার
Medicallife24.com
https://medicallife24.blogspot.com/2014/06/blog-post.html
https://medicallife24.blogspot.com/
https://medicallife24.blogspot.com/
https://medicallife24.blogspot.com/2014/06/blog-post.html
true
386760340000872788
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS CONTENT IS PREMIUM Please share to unlock Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy