এক রুগীর লাম্বার পানকচার করে CSF নিয়ে শেষ করে গ্লাভস খুলব মাত্র, এই সময়েই মেডিসিন ইউনিট-২ এর সিএ ডা সুব্রত দা ডাক দিলেন,"মুনাদি তাড়া...
রাত সাড়ে ৮ টার দিকে বিষাক্ত সাপের কামড় নিয়ে আসে এক রুগী।সহকর্মী ইন্টার্ন সুমাইয়া রুগী রিসিভ করে মিডলেভেল ভাইদের ডাক দিতেই ডা মালিক, ডা সাইফুল ডা হান্নান ভাই, ডা সেতু আপু সহ সবাই এসে দেখে বিষাক্ত সাপের কামড়ের সব উপসর্গই আছে, ptosis, broken neck sign..সহ সব। ডা সেতু আপু দৌড়ে গিয়ে ওয়ার্ডের পোর ফান্ড থেকে আনলেন এন্টি ভেনম। আমি, ডা সাইফুল ভাই, ডা শোভন ভাই আর সেতু আপু মিলে লেগে গেলাম এন্টি ভেনমের দশ দশটা ভায়ালে নরমাল স্যালাইন টেনে গুলাতে। এই কাজ যে কতটা কষ্টের তা যারা করেছে তারাই জানে, আর আজকে প্রথমবারের মত আমি বুঝিলাম! প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর সব ভায়াল ডায়লুট করে আরো ১০০মিলি নরমাল স্যালাইনে দিয়ে রুগীর শিরায় দেয়া হলো। এদিকে ততক্ষণে ডা লিমন, ডা মালিক, ডা রনি, ডা তন্ময় ভাই সহ ডা সুমাইয়া মিলে অন্যান্য আনুষংগিক ওষূধগুলো দেন।
এন্টিভেনম চালু করে রুগীকে অক্সিজেন পয়েন্টে নিয়ে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছিল, ডা সুব্রত দা, আর ডা মালিক ভাই সার্বক্ষণিক মনিটর করতে করতে এর ২০-২৫ মিনিট পর দেখেন রুগী শ্বাস নেয়া বন্ধ হয়েছে অর্থাৎ রেস্পিরেটরি এরেস্টে চলে গিয়েছে, এই মুহূর্তেই ডা সুব্রত দা আমাকে ডাকটা দেন। দেখি রুগীর কোন পালস নেই। ট্রলিতে করে ডা মালিক ভাই, ডা সুব্রত দা আর আমি রুগীকে নিয়ে গেলাম ওটিতে, দেখি ওটি বন্ধ রুটিন আর ইমার্জেন্সি ওটির মধ্যখানে ওয়াশের জন্য, ওটি দাদুকে ডাক দিয়ে কোনমতে খুললাম ওটি, দাদু কে দিয়ে ইন্টিউবেশন টিউব আনাতে ডা মালিক ভাই নিজেই ইন্টিউবেশন করলেন, আমি আর সুব্রত দা পালাক্রমে CPR (Cardipalmonary Resuscitation) দেয়া শুরু করলাম,। এদিকে ততক্ষনে সার্জারি ৩ এর ডা দিপনকর দা আর এনেস্থেসিয়ার ভাইয়া এসে হাজির হলেন। রুগি দেখে দীপংকর দা পুরাই নিরাশাবাদী, ফিরবে না। কিন্তু আশা হারাই নি আমরা তিনজন, বার্ডেমে করা CPR কোর্সে শেখা জিনিসগিলুলো মনে করতে করতে মনে পরল Adrenalin দেয়া লাগবে, দিলাম সাথে সাথে। এভাবে CPR দিতে দিতে প্রায় ১৫ মিনিট পরে ডা সুব্রত দা বললেন, "পালস এসেছে!" দেখি হার্ট রেট ১১০, অক্সিজেন স্যাচুরেশন ১০০%! সাথে সাথে পরিবর্তন হয়ে গেল ওটির পরিবেশ, স্বস্তির নিশ্বাস সবার মুখে কিন্তু টেনশন কমেনি, কী কিরা যাবে এর পরে, আমাদের ICU খালি নেই, সায়েমে যোগাযোগ করতে তারা রুগী নিতে রাজি হলো।
আম্বু ব্যাগিং করে এরপর রুগীকে ট্রলিতে করে ওটি থেকে বের করছিলাম ওয়ার্ডে নিবো এসময় অন্য এক রুগীর লোক বলল, "ডাক্তাররা কী চেষ্টাটাই না করলো রুগী বাঁচাতে " এরপর রুগীকে ট্রলিতে আম্বু ব্যাগ চাপতে চাপতে যখন ব্যালকনি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম তখন রুগীর বড় ভাই কাদো কাদো স্বরে বলছিল "স্যার আপনারা যা করলেন, যে চেষ্টাটা করলেন কী বলব স্যার আমার বলার ভাশা নাই! স্যার, এত কষ্ট করেছেন স্যার আমার ভাইটার জন্য, আল্লাহ আপনাদের অনেক দিবো স্যার, অনেক দিবো!"
আমি বেরসিক মানুষ বললাম, "কেন আপনারাই তো বলেন, পত্রিকায় লেখে ডাক্তাররা অবহেলা করে"
রুগীর ভাই- "কক্ষনো না স্যার, আজ নিজের চোখে যা দেখেছি, এগুলো সব মিথ্যা লেখে।"
রুগী ICU তে পাঠানোর আগে ওয়ার্ডে আরো এন্টি ভেনম আর আম্বু ব্যাগিং করতে অক্সিজেন পয়েন্টে নিয়ে নামাতে যাবো দেখি আবার পালস নাই, আবার এট্রোপিন দিলাম, CPR দিলাম আরো কিছুক্ষণ, কিন্তু বিফল। সব কিছু দেখে রুগীর মৃতু ডিক্লেয়ার করতেই রুগীর ভাই কেঁদে দিয়ে বলে উঠল "আপনারা তো অনেক করেছেন, আল্লাহর তো ফয়সালা স্যার আল্লাহর ফয়সালা... আমার ভাইরে নিবে এটাই ছিল কপালে!"
নিজেকে তখন বিশ্বাস করতে হচ্ছিল সত্যি আমাদের কাজের স্বীকৃতি দিয়ে "মৃত্যুকে আল্লাহর ফয়সালা" বলে মেনে নেয়ার লোক, মেনে নেয়ার মানসিকতার মানুষ আর রুগীর লোক আজো আছে। এরা মৃত ভাইয়ের লাশ সামনে নিয়েও স্বীকার করে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আমাদেত শ্রমের, আমাদের চেষ্টার! তাকিয়ে দেখি সত্যি স্বজনহারা ভাইয়ের কান্নার অশ্রুর প্রতিটি ফোটা যেন বলছিল, "আমরা কৃতজ্ঞ"
এজন্যই আজো কাজ কিরে যাই এ মানুষগুলোর জন্য, দিনকে রাত করে রাতকে দিন করে.... ইনাশাআল্লাহ করে যেতে চাই জীবন ভর, এজন্যই আমরা ডাক্তার, কিছু অকৃতজ্ঞের ভাষায় "কসাই"...
লিখেছেন ----- মুনাদি আল ইসলাম
এ সাইটে লিখতে যোগাযোগ করুন -
-ডাঃ স্বাধীনফেসবুক লিংক - http://fb.com/DrREAL
সবাইকে মেডিকেলীয় আড্ডা গ্রুপে যোগ দেয়ার আমন্ত্রন -
------ মেডিকেলীয় আড্ডা গ্রুপ
গ্রুপ ও পেইজে যোগ দিতে নীল লেখার উপর ক্লিক করুন ।
http://www.fb.com/adda12 মেডিকেলীয় - আড্ডা ツ